লৌকিক অলৌকিক
গৌড়াধিপতি দেবপাল–তিনি পরমভক্ত ধার্মিক,
সুশাসক নৃপ–রাজ্যে শান্তি বিরাজিত চৌদিক।
দেবমন্দিরে মনোহর শ্যাম–দিব্যবিগ্রহ,
কনকমূর্তি কৃষ্ণে ভজেন দেবপাল অহরহ।
তিলক–ললাম,মাথে কেকীপাখা–মোহন মুরলী করে,
নিক্কণ বাজে চরণকমলে–রাজার চিত্ত হরে।
রাজকার্যেই ব্যাস্ত–তথাপি অনিবার শ্যাম ধ্যান,
তাঁহার শোভায় রাজ–অন্তরে আনন্দ অফুরান।
প্রতি প্রত্যুষে স্নানের অন্তে পুষ্প–মালিকা চন্দন,
পুত সুরধুনী বারিতে করেন শ্রী হরির বন্দন।
পন্চপ্রদীপে বিষ্ণু আরতি–অন্তর শ্যামময়,
দেবতার ধ্যানে রাজ–হিয়াখানি অন্তর্মুখী রয়,
দেউল–দুয়ার রুদ্ধ তখন–বহির্জগৎ লুপ্ত,
কিন্তু নৃপের এহেন সেবার সন্দেশ নহে গুপ্ত।
গুর্জররাজ মিহিরভোজের একটি সূক্ষ্ম আশ,
দেবপালে তিনি করিবেন দাস–স্পর্ধিত অভিলাষ।
গৌড়রাজের পূজার্চনার এমত সন্ধিক্ষণ,
সুযোগ সমীপে–করিলেন তিনি বংগ আক্রমণ।
রক্তিম পূব ঊষার গগন–সদ্য সূর্যোদয়,
দেবপাল শ্যামধ্যানেতে মগ্ন–ভোজরাজ নির্ভয়।
আসেন ত্বরায় দেবসেনাপতি–লাউসেন বুঝি ক্রুদ্ধ,
তন্ময় নৃপ বিষ্ণু ব্যজনে–মন্দির দ্বার রুদ্ধ।
হায়রে তাঁহারে কে দিবে এখন সংগ্রামে অনুমতি,
তবে কি গৌড় গুর্জর সনে স্বীকার করিবে নতি !
রাজমাতা তথা রাজমহিষীর প্রচেষ্টা নিষ্ফল,
ব্যর্থ মায়ের কাতর আকুতি–রাণীর নয়নজল।
নরেশ তখন আত্মভোলা যে–তাই কোনো আহ্বানে,
অন্তর বুঝি দেয় না কো সাড়া–মুখর যে শ্যামগানে।
রাজসেনামুখ দেউল দুয়ারে–চন্চল সবে ত্রস্ত,
কখন বাহিরে আসিবেন নৃপ–গৌড় বিপদগ্রস্ত।
কিন্তু তাহারা একটি কারণে বিষ্মিত কিন্চিত,
সহসা কিরূপে অরিহুঙ্কার স্তিমিত,অন্তরিত।
অবশেষে খোলে লৌহকপাট–শ্যামপূজা সমাপন,
বাহিরে আসেন গৌড়নরেশ–জিজ্ঞাসু দুনয়ন।
হেরিয়া তাঁহারে সৈন্যবাহিনী জয়রব দেয় হর্ষে,
এক নিমেষেই দৃশ্যান্তর বুঝি কোনো যাদুস্পর্শে।
প্রণাম অন্তে কহেন সেনানী–সুপ্রিয় মহারাজ,
মোদের রাজ্য গুর্জর দ্বারা অতিক্রান্ত আজ।
চাহি অনুমতি–ভোজরাজে আজি দিব সমুচিত শিক্ষা,
এমত দশাটি করিব তাঁহার–মাগিবেন প্রাণভিক্ষা।
কহিলেন নৃপ–কোথা মোর হয়, কোথা শ্বেত রণহস্তী !
যুদ্ধক্ষেত্রে যাইব এখনি–অরি বিনাশেই স্বস্তি।
সহসা পরিধি সচকিত ভারী–হ্রেষারব অবিশ্রান্ত,
রাজ–অশ্বটি আসে দ্রুতবেগে–বুঝি বা অধিক ক্লান্ত।
জিহ্বাটি ঘন লালায় সিক্ত–স্বেদ ঝরে হেথাহোথা,
কেমনে সাজিল রণসাজে হয়– এতক্ষণ ছিল কোথা !
বিষ্মিত দেব,সেনা ও সেনানী ঘোটকের ভাব হেরি,
নৃপতি আসীন হস্তীপৃষ্ঠে–বাজিল তুর্য্য ভেরী।
রাজ তুরগের বিশ্রাম হেতু হস্তীর বৃংহন,
চলেন রাজন বীরবিক্রমে লক্ষ্য রণাঙ্গণ।
কিন্তু সেথায় দৃশ্যটি হেরি’ দেবপাল বিহ্বল,
শত্রুসৈন্য অচৈতন্য–অতিশয় হীনবল।
তাহাদের মাঝে অসহায় অরি নৃপতি মিহিরভোজ,
দাঁড়ায়ে একাকী যুদ্ধক্ষেত্রে–নয়ানে কাহারো খোঁজ।
দেবপালে হেরি গুর্জরপতি আসেন ত্বরায় ছুটি,
অশ্রুধারায় সিক্ত করেন নৃপতির কর দুটি।
কহেন–রাজন,শ্যামলকান্তি তব সিপাহীর তরে,
সঁপি দিনু আজি তনমনপ্রাণ–করুন বন্দী মোরে.
দিনু এইক্ষণে রাজত্ব–মম সম্পদ,ঐশ্বর্য্য,
আর একটিবার মিলিব তাহারে–এই অনুনয় আর্য।
তাহার সমখে মম সেনাদল–সকলেই হতবীর্য,
অপরূপ কায়া,তরুণ সিপাহী–যেন সে দীপ্ত সূর্য।
শুনি’ বর্ণনা গৌড় নৃপের বিষ্ময়াবেশ ভারী,
কহেন–হে ভোজ, গুর্জররাজ কিছুই বুঝিতে নারি।
শ্যামলকান্তি নবীন সিপাহী–হৃদয় মাঝারে ছবি,
বাস্তব সাথে বড়ই অমিল–কোথায় তাহারে লভি !
সহসা ভক্ত দেবপাল হিয়া অনুভবে শিহরণ,
নয়নে অশ্রু,মুখমণ্ডল বুঝি বা রক্তবরণ।
গুর্জররাজে আলিংগণ–ধন্য আপনি ধন্য,
আপনার সনে গৌড়াধিপতি দীন,হীন অতি নগণ্য।
যাঁহার ধ্যানেতে মগণ এ অধম দেবপাল অনুক্ষণ,
লভিলেন আজি ভাগ্যবন্ত তাঁহারই যে দরশন।
তিনিই ত’ দেব শ্যামসুন্দর–আর কে হইতে পারে !
সিপাহীর বেশে আসিলেন যিনি রক্ষা করিতে মোরে।
পুণ্য অধিক আপনার তাই–হেরিলেন দেব শ্যামে,
গৌড়াধিপের কপোল ব্যাপিয়া অশ্রুর ঢল নামে।
আমি পাপিষ্ঠ,ভাগ্যপিষ্ট–সেইহেতু মম ইষ্ট,
দরশন মোরে দিলেন না এবে–গৌড়নরেশ ক্লিষ্ট।
আপ্লুত ভোজ গুর্জররাজ–হে নৃপ ধার্মিক,
আপনার প্রতি অরি মনোভাব–ধিক্ মোরে শতধিক্।
এমন ভকতি তুলনাবিহীন বুঝি এই ধরামাঝে,
বিষ্ণু যাঁহার স্বয়ং সহায়–অশ্রু কিরূপে সাজে !
আজি হতে দোঁহা পরম মিত্র–বিদ্বেষভাবে ইতি,
আকর্ষণ করেন দেবেরে–আপন বক্ষে স্থিতি।
গুর্জর সেনা–ফিরিল চেতনা–প্রণত শ্রী গোপীনাথে,
দুই পক্ষের সেনাবাহিনী প্রীতি উৎসবে মাতে।
সমরাঙ্গনে হইল সৃষ্টি মিলনমেলার চিত্র,
নহে কেহ অরি–আনন্দ ভেরী–পরস্পরের মিত্র।
দেবপাল সাথে মিহিরভোজের দীর্ঘ আলিংগণ,
ঝরিল না কোনো শোণিতবিন্দু–বাঁধিল না মহারণ।
গৌড়নৃপতি,গুর্জরপতি দেব দেউলেতে আসি,
হেরিলেন শ্যামসুন্দরে–আহা আননে অরূপ হাসি।
প্রতাপাণ্বিত মহারথীদ্বয়ে শত্রুতা অবসান,
মুরলিধর করেন রক্ষা দুজনার কুল মান।
গৌড়রাজ্যে সেদিন ঘটিল যে অত্যদ্ভুত ঘটনা,
ইতিহাস কভু দেয় না সাক্ষ্য–বলে সব কল্পনা।
তথাপি কি মোরা দেব মহিমারে করিব অস্বীকার!
পাঠকের সনে সত্য মিথ্যা দিনু বিচারের ভার।
———————————————————-
স্বপন চক্রবর্তী।