Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

পিকলুর গল্প

প্রিয়জনের সঙ্গে শেয়ার করুন :--👍

Loading

মা বাবা দিদি আমিমোদের পরিবার,

অবস্থা মোটেই তখন ছিল না চটকদার।

নুন আনতেই পান্তা ফুরায়এমন ছিল দশা,

কঠোর ভাবেই নিষেধ বুঝি ঘরেতে কারো হাসা।

বাড়ির কোনো মামলায় হায় খরচ অঢেল টাকা,

ব্যয় হতো জলের মতোইবাবার পকেট ফাঁকা।

টানাটানির সংসারযবে সবই লণ্ডভণ্ড,

সেই সময়ে দিদি আমার করলো সে এক কাণ্ড।

কত বছর আগের কথামোর বয়স অল্প,

ভাবছ বুঝি সবটা আমার কল্পনার গল্প !

গিয়েছিল দিদি সেদিন প্রিয় বন্ধুর বাড়ি,

পরণে তার ঝকঝকে এক সোনারঙের শাড়ী।

গেল একাফিরলো দুজনকুকুর ছানা কোলে,

তার রঙেই শাড়ীর রঙদুটোই যেন মেলে।

ঝোলা ঝোলা কানদুটো তারচক্ষুদুটি গোল,

দিদির গায়ে লেপ্টে ছিলখাচ্ছিল সে দোল।

আমি বললাম – “কি করেছিসআনলি কুকুরছানা !

কুকুর যে রোজ মাংস খায়নেই কি সে তোর জানা !

সেই যে কবে মাংস খেলাম ভুলেই গেছি দিদি,

কি কাণ্ড হবেমায়ের চোখেই পড়ে যদি।

বাবা আজকে অফিস গেছেতাই বুঝি তোর রক্ষে,

যার কুকুর ফিরিয়ে দিয়ে আয়কেন করেছিস ভিক্ষে !”

ভিক্ষে কোরেকে বললোএমনি দিল মাসী,

বাচ্চা ওদের গুটি কয়কুকুরটা নয় দিশি।

ইংরাজী নাম জানিস কি ভাই-‘গোল্ডেন রিট্রিভার’,

এমন কুকুর সারা বিশ্বে জুড়ি নেইকো আর।

বড় হলে গায়ের রংটা হবেই পাকা সোনা,

মিষ্টি মুখ, ঝোলা কান, চক্ষু টানা টানা।

মনে হল ভাসছে স্বপন দিদির দুচোখ মাঝে,

দিদির কথায় থাকতে নারে ভাইটি মুখ বুজে !

হেসে ফেললাম খুবই জোরেসেটাই হল কাল,

ছুটে এসেই কুকুর দেখে মা রেগেই লাল।

কাণ্ডজ্ঞান নেই কি তোরকুকুর পুষব বটে !

কুকুর পোষার ঝক্কি জানিস”-মা গিয়েছেন চটে।

বড়লোকের বড় শখএমন কুকুর পোষে,

আমরা খুকু বড়ই গরীবকেমনে শখ আসে !

কুমড়োর ঘ্যাঁট , আলুসেদ্ধ কোনক্রমে জোটে,

এসব খাবেন মহারাজরুচবে নাকো মোটে।

মুখ চুনকুকুর দিদি নামিয়ে দিল নীচে,

চালাক কুকুরগুটিগুটি গেল মায়ের কাছে।

তারপর সে একলাফে মায়ের কোলের পরে,

ঘুমিয়ে পড়েও এক নিমেষেদারুণ বুদ্ধি ধরে।

মায়ের মুখে ফোটে হাসিনরম নরম লোমে,

হাত দুটি বুলিয়ে দিয়ে আদর করেন ক্রমে।

বাবাকে নিয়েই ভয় ছিল তাঁরহলে অপছন্দ,

বলা যায় নাসময় এখন সত্যি ভারী মন্দ।

মা বললেন-“থাকা না থাকাপিকলুর দায় মস্ত,”

ইতিমধ্যেই কুকুরের নাম পিকলুই সাব্যস্ত।

অফিস থেকে ফেরেন বাবাযেই না ঢোকেন ঘরে,

পিকলু অমনি লেজটা নেড়ে তাঁকে আদর করে।

আরে আরে এটা কে রে”-তুলে নিলেন খাটে,

কুকুর বাবার এত প্রিয়জানা ছিল না মোটে !

কে দিল এমন কুকুর-‘গোল্ডেন রিট্রিভার’!

আমার পোষার শখ ছিল”-খুব উল্লাস তাঁর।

মায়ের কাছে সব শুনে বাবাও দারুণ খুশী,

আনন্দেতে দিদি কাঁদে,মা কাঁদে বেশী।

পিকলু রইল দিদির সাথে মোদের পরিবারে,

আমি,দিদি জলখাবার খাওয়াই দিলেম ছেড়ে।

মন দিয়ে পড়াশুনাপ্রথম হতেই হবে,

প্রথম হলেই পড়ার খরচ অনেক বেঁচে যাবে

পিকুর জন্য মাংস চাই হোক না যেমন করে,

ছোট্ট প্রাণী খুশীর হাওয়া আনল মোদের ঘরে।

সুখের অনেক আলো বুঝি ঘরে উপচে পড়ে,

মোকদ্দমায় বাবার জিতভাগ্য গেল ঘুরে।

সাত বছরের মামলাতে পরাজয় নিশ্চিত,

সেই মামলায় আমার কিনা হলোই শেষে জিত !

সব কিছুই পিকুর হেতুকুকুরটা পয়মন্ত,

অর্থ আর সংসারে হবেই না বাড়ন্ত।

ওর জন্য মাংস চাইদিনে এবং রাতে, “

বাবার খুশী উপচে পড়ে হারা মামলা জিতে।

বাবার কথায় আমাদেরও খুশী অন্তহীন,

বুঝি এবার সত্যি মোদের পাল্টাচ্ছে দিন।

এর পরেও আরেক কাণ্ডউন্নতি তাঁর পাকা,

বিশ বছরের চাকরী বাবারঘোরে তারও চাকা।

পিকলু বাবুর হাতেই মোদের সুখের চাবিকাঠি,

ওকে ছাড়া আমরা অচল”-বাবার কথাই খাঁটি।

ধাপে ধাপে বাড়ে মোদের সংগতি আর বিত্ত,

পিকুর আদর বর্ধমান সেই সাথেই নিত্য।

পিকলু ছিল সব কথায় বাবা মায়ের বাধ্য,

মন্দ কাজ করায় তাকেকার এমন সাধ্য !

সেই পিকুর হলেম মোরা ভক্ত একনিষ্ঠ,

তার পরশে কেমন করে হয়ে গেলেম শিষ্ট

চুক্তি হল দুজনারপরস্পরের প্রতি,

রাখব নজর অহর্নিশজীবন পাবে গতি।

এবার মোদের পরীক্ষাকি হয় কে জানে,

দিদির হল প্রথম স্থান, আমি এলাম তিনে।

কষ্ট হল খুবই আমারপেল কেমন কান্না,

ওমা দেখি পিকুর চোখেও যেন জলের বন্যা।

জেদ চাপলোআরো আমায় করতে হবে ভালো,

পরের বছর হৃদয় জুড়ে অনেক তারার আলো।

এমন করেই দিনে দিনে বয়স গেল বেড়ে,

বাবা মায়ের পাকা চুলপিকুও পিছু ধরে।

দিদির তখন স্নাতোকত্তরভাইটির প্রযুক্তি,

তবুও মাঝে চালু ছিল কবেকারের চুক্তি।

কিন্তু পিকুতার পায়ে যে জোর গিয়েছে কমে,

একা একাই শুয়ে থাকেকেমন গেছে দমে।

হঠাৎ সেদিন দ্বিতল থেকে নামার সময় হায়,

পড়লো নীচে সিঁড়ির থেকেপ্রাণটি বুঝি যায়।

সে যাত্রায় বেঁচে গেলেও পঙ্গু হল পিকু,

তার জন্য মোদের সবার মনটা আঁকুপাঁকু।

অহর্নিশ করলো সেবা আমার দিদি তাকে,

এমনতরো ভালবাসাঅবাক হতেম দেখে।

দিদি ছিল আমার কাছে মা দুর্গার রূপে,

যাঁকে আমরা পূজা করি নিত্য জপে তপে।

মোদের বাড়ীর গর্ব দুটিপিকলু এবং দিদি,

দিদি যেন অমরাবতীর অলকানন্দা নদী।

যে নদীতে যাবেই শেষে মোদের পিকলু ভেসে,

দুজনার কষ্টে আমার দুচোখ জলে ভাসে।

একটা সুঁই দিলে পরে পাঁচ মিনিটের শেষে,

পিকলু সোনা যাবে চলে চিরশান্তির দেশে।

ডাক্তারের নিদয় কথায় দিদির হাহাকার,

এমন কাজ কখ্খনো নয়শুনুন ডাক্তার।

মানুষ হলে এমনটা কি যায় কখনো করা !

বিষয়ে করতে নারি কোনই বোঝাপড়া।

পিকলু মোদের পরিবারের হৃদয় তথা প্রাণ,

এককথায় হয়ত সে আমারই সন্তান।

তার সঙ্গে নিষ্ঠুরতাসেটি কৃতঘ্নতা,

শেষযাত্রায় রাখবে পিকু আমার কোলে মাথা।

যে কদিন বাঁচবে বাঁচুককরবো সেবা আমি,

পিকলু আমার এই জীবনে সবার চেয়ে দামী।

চলে গেলেন চিকিৎসকবুঝলো পিকু বুঝি,

সহসা সে দিদির দিকে তাকায় সোজাসুজি।

চোখের কোণে জলের ফোঁটাকরুণ যেন দৃষ্টি,

সেই রাত্রে আকাশ ভাঙা মুষলধারায় বৃষ্টি।

রাত তখন দশটা বাজেখাওয়ায় দিদি তাকে,

দুএক ফোঁটা দুধও বুঝি যায় না পিকুর মুখে।

আদর করে চুমু খেয়ে রাখল কোলে মাথা,

এবার যেন পিকুর সাথে দিদির কত কথা।

চোখগুলো হায় বন্ধ তবুহঠাৎ মাথা তুলে,

কি বা কাকে দেখতে সে চায় নয়নদুটি খুলে।

অবশেষে দিদির দিকে পিকলু তাকায় ফের,

বললে যেন করুণ গলায় – “করলে সেবা ঢের।

এবার আমায় দাও মা বিদায়পেওনা তুমি ব্যাথা,”

দিদির কোলেই পিকলু সোনার পড়লো নিথর মাথা।

চলে গেল পিকলু সোনা সেই বৃষ্টির রাতে,

নীরব মিছিল এগোয় মোদের পিকুর শব হাতে।

কাঁদছে দিদি, কাঁদছে মাবলেন বাবা মোরে,

ভাসিয়ে দাও পিকুর শব মা গঙ্গার নীরে।

এক মায়ের কোল থেকে আরেক মায়ের কোলে,

বিসর্জন দিলেম তারে ভরা গঙ্গার জলে।

আজো একটা ধূপ জ্বলে সেই অমল ছবির পাশে

যেথায় পিকুর গলা জড়িয়ে আমার দুগ্গাদিদি হাসে।

বাবাও নেই, মাও নেই , দিদিও গেছে চলে,

কেবল আমি আজও ভাসি নীরব চোখের জলে।

——————————————————————-

মূল কাহিনী শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক সন্জীব চট্টোপাধ্যায়ের।  তাঁরদিদি আর পিকলু”, – একটি মায়াময় ছোট কিশোর কাহিনীরকাব্যরূপ দেবার আমার একটি ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা মাত্র। মহান লেখকের প্রতি আমার অসীম কৃতজ্ঞতা।

0

Publication author

1
একটি বহুজাতিক সংস্থায় প্রবন্ধক পদে কর্মরত ছিলাম। ২০১৭ সালে ৬০ বছর বয়সে অবসর নিয়েছি । এখন কবিতা ও গল্প লেখা আমার অবসরের সাথী।
Comments: 0Publics: 25Registration: 26-08-2020
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

পরিচিতি বাড়াতে একে অপরের লেখায় মন্তব্য করুন। আলাপের মাধ্যমে কবিরা সরাসরি নিজেদের মধ্যে কথা বলুন। জমিয়ে তুলুন কবিতার আড্ডা।