আহ্বান
দুটি ভাত দেবে – চারদিন ধরে পড়েনি কিছুই পেটে,”
মা বলে আমারে – “খাবার সময় কে এল দুয়ারে বটে।”
উঁকি দিয়ে দেখি দুয়ারে দাঁড়ায়ে দুখিনী রমণী এক,
ছিন্ন বস্ত্র, শীর্ণ চেহারা – বুঝলাম নহে ভেক।
ছোট ছোট তিন শিশু তার সাথে–অপর একটি কোলে,
কেমন করে বলি আমি তারে – “যাও এইক্ষণে চলে ! ”
অর্গল খুলি’ বলি দুখিনীরে – “দিদি গো ভিতরে এসো,
তোমাদের তরে প্রস্তুত আজি অন্ন–একটু বসো।”
“ক্ষুধার জ্বালায় চারদিন ধরে শিশুগুলি কাঁদে পথে,
যেখানেই যাই–করে দূর দূর–দেয় না কিছুই হাতে ।
মা হয়ে আমি কেমন করে গো দেখি শিশুদের কষ্ট,”
অশ্রুরধারায় যায় ভেসে নারী – “হায় মোর অদৃষ্ট।
পূজার সময় কত ধূমধাম শহরের চারিদিকে,
নতুন পোশাক সবার পরণে–কে হায় মোরে দেখে।
আমার কথা নয় দিনু ছেড়ে”-কহে সে শীর্ণকায়া,
কি দোষ হায় এই শিশুদের–হয় না কি কারো মায়া !”
শুধাই রমারে – “সিঁথিতে সিঁদুর,হাতেও রয়েছে শাঁখা,
কি করেন দিদি স্বামীটি তোমার–পাও না কি তার দেখা !”
“রমণী রূপসী নিঃসন্দেহে–তবে দরদীয়া বনমালী,
দীনতা আড়ালে লুকায়ে রেখেছে অমল রূপের ডালী।
নচেৎ ধরার শতেক অসুর ঝাঁপাত নারীর ঘাড়ে,”
হঠাৎ দিদির সুরেলা কণ্ঠে চিন্তায় ছেদ পড়ে।
“সে ত’ নেশাখোর–গাঁজা ভাঙ খেয়ে পড়ে থাকে ইতিউতি,
তার জন্যেই আমার ত’ আজ হায় এত দুর্গতি।
তবে মন্দ হলেও সে ভোলানাথ–মোরে খুব ভালবাসে,
গালমন্দ করি তারে খুবই–সে দেখি শুধুই হাসে।”
“কোথায় বাড়ী মা তোমাদের শুনি–এলে গো কেমন করে !”
“দূর আছে বটে–এসেছি হেথায় অনেক জায়গা ঘুরে।
অত কথা কেন শুধাও গো বাপু–দেবে কি দুমুঠো খেতে !
সাফ কথা বলো–ঘোরপ্যাঁচ কেন–বেরোই আবার পথে।”
“না না বাছা শোন–এসেছই যবে এই গরীবের ঘরে,
খেয়ে যাও দুটি” – পিছনে তাকাই মায়ের কণ্ঠস্বরে।”
কখন মা যে এসেছে পিছনে বুঝতে পারিনি মোটে,
“অভুক্ত কেন রবে মা আজকে যদি আমাদেরও জোটে।
আজ বিজয়ার বিষাদ লগ্নে সঞ্চয় করি পুণ্য,
বসে পড়ি চল সব একসাথে–প্রস্তুত পরমান্ন।”
চেটেপুটে খেল দুখিনী রমণী আর তার শিশুগুলি,
তাদের মুখের অনাবিল হাসি–কেমন করে তা ভুলি !
যাবার সময়ে দুখিনীর হাতে তুলে দিনু কিছু অর্থ,
ভাবলাম আজি দিনটা মোদের হয়নি মোটেই ব্যর্থ।
“শিশুদের তরে পোশাক আর তোমার জন্য শাড়ী,
কিনে নিও দিদি–মোরা খুবই দীন–আর কিছু দিতে নারি।”
দিদির আননে খুশীর ঝলক–আমরাও সুখী অতি,
মনে হল যেন মোদের আঙনে স্বয়ং দাঁড়ায়ে সতী।
রাতের বেলায় আঁধার ঘরেতে হঠাৎ আলোক রাশি ,
জগত জননী দাঁড়ায়ে সমুখে–নয়নে মধুর হাসি,
কহিলেন তিনি – “ঠিকই ভেবেছিলি–আমিই ত’ পার্বতী,
এসেছিনু আজি তোদের কুটীরে সাথে লয়ে সন্ততি।
তোদের সেবায় পরম তৃপ্ত–রবে না অর্থকষ্ট,
হৃদয় মাঝারে যে রাখে আমারে–তার প্রতি আমি তুষ্ট।
আর যারা করে আর্তের সেবা তারা পূজে ঈশ্বরে,
তাই এসেছিনু দুখিনীর বেশে আজকে তোদের ঘরে।”
মা দশভুজা অন্তর্হিতা–নিদ্রা গিয়াছে টুটে,
যা দেখলাম–সব কি সত্য–নাকি সে স্বপ্ন বটে !
কত বছরের পুরানো ঘটনা–আজো জাগে শিহরণ,
দুখিনীর বেশে দেবী দর্শন–কাঁপে যেন তনুমন।
ভাবছ বুঝি বা কল্পকাহিনী–সত্যতা নেই মোটে,
আমার সঙ্গে আলাপ সবার কম দিন নয় বটে।
এমন ঘটনা আমার জীবনে–নিশ্চিত হতো জানা,
সত্য মিথ্যা সে যাই ভাবো–আমার কিসের মানা !
তবে এই কথাটুকু বলতেই পারি–অনুভূতি মোর স্পষ্ট,
অর্থগরিমা বাগাড়ম্বরে জননী আজিকে রুষ্ট।
ভক্তি কোথায়–যেথা হেরি হায় জমকের বাড়াবাড়ি,
অনাচার তথা ব্যাভিচার বুঝি ঘোরে হাতে হাত ধরি’।
তাই পরিণামে পৃথ্বীর লয়–চৌদিকে হাহাকার,
রসাতলে বুঝি নিমজ্জমান ধরণীর সংসার।
আহ্বান করি হয়োনাকো কেহ বিস্মৃত এইক্ষণে,
জননী সতত নিবাস করেন অনাথ আতুর সনে।
তাদেরকে যদি ঘৃণা করো সবে–করো সদা অবহেলা,
তবে জেনো দেবী রবেন কেবলই কিছুটা মাটির ডেলা।
মৃণ্ময়ী মাকে যদি সত্যই মাগ চিন্ময়ী রূপে,
মানুষের সেবা কর মহাজন নিরহংকারী রূপে।
শিবের বণিতা জননী শিবাণী ভগবতী পার্বতী,
ক্ষমা করো মাগো–সন্তান তব–ওগো অমৃতজ্যোতি।
——————————————————————-