পিকলুর গল্প
মা বাবা দিদি আমি–মোদের পরিবার,
অবস্থা মোটেই তখন ছিল না চটকদার।
নুন আনতেই পান্তা ফুরায়–এমন ছিল দশা,
কঠোর ভাবেই নিষেধ বুঝি ঘরেতে কারো হাসা।
বাড়ির কোনো মামলায় হায় খরচ অঢেল টাকা,
ব্যয় হতো জলের মতোই–বাবার পকেট ফাঁকা।
টানাটানির সংসার–যবে সবই লণ্ডভণ্ড,
সেই সময়ে দিদি আমার করলো সে এক কাণ্ড।
কত বছর আগের কথা–মোর বয়স অল্প,
ভাবছ বুঝি সবটা আমার কল্পনার গল্প !
গিয়েছিল দিদি সেদিন প্রিয় বন্ধুর বাড়ি,
পরণে তার ঝকঝকে এক সোনারঙের শাড়ী।
গেল একা–ফিরলো দুজন–কুকুর ছানা কোলে,
তার রঙেই শাড়ীর রঙ–দুটোই যেন মেলে।
ঝোলা ঝোলা কানদুটো তার–চক্ষুদুটি গোল,
দিদির গায়ে লেপ্টে ছিল–খাচ্ছিল সে দোল।
আমি বললাম – “কি করেছিস–আনলি কুকুরছানা !
কুকুর যে রোজ মাংস খায়–নেই কি সে তোর জানা !
সেই যে কবে মাংস খেলাম ভুলেই গেছি দিদি,
কি কাণ্ড হবে–মায়ের চোখেই পড়ে যদি।
বাবা আজকে অফিস গেছে–তাই বুঝি তোর রক্ষে,
যার কুকুর ফিরিয়ে দিয়ে আয়–কেন করেছিস ভিক্ষে !”
“ভিক্ষে কোরে–কে বললো–এমনি দিল মাসী,
বাচ্চা ওদের গুটি কয়–কুকুরটা নয় দিশি।
ইংরাজী নাম জানিস কি ভাই-‘গোল্ডেন রিট্রিভার’,
এমন কুকুর সারা বিশ্বে জুড়ি নেইকো আর।
বড় হলে গায়ের রংটা হবেই পাকা সোনা,
মিষ্টি মুখ, ঝোলা কান, চক্ষু টানা টানা।”
মনে হল ভাসছে স্বপন দিদির দুচোখ মাঝে,
দিদির কথায় থাকতে নারে ভাইটি মুখ বুজে !
হেসে ফেললাম খুবই জোরে–সেটাই হল কাল,
ছুটে এসেই কুকুর দেখে মা রেগেই লাল।
“কাণ্ডজ্ঞান নেই কি তোর–কুকুর পুষব বটে !
কুকুর পোষার ঝক্কি জানিস”-মা গিয়েছেন চটে।
“বড়লোকের বড় শখ–এমন কুকুর পোষে,
আমরা খুকু বড়ই গরীব–কেমনে এ শখ আসে !
কুমড়োর ঘ্যাঁট , আলুসেদ্ধ কোনক্রমে জোটে,
এসব খাবেন মহারাজ–রুচবে নাকো মোটে।”
মুখ চুন–কুকুর দিদি নামিয়ে দিল নীচে,
চালাক কুকুর–গুটিগুটি গেল মায়ের কাছে।
তারপর সে একলাফে মায়ের কোলের পরে,
ঘুমিয়ে পড়েও এক নিমেষে–দারুণ বুদ্ধি ধরে।
মায়ের মুখে ফোটে হাসি–নরম নরম লোমে,
হাত দুটি বুলিয়ে দিয়ে আদর করেন ক্রমে।
বাবাকে নিয়েই ভয় ছিল তাঁর–হলে অপছন্দ,
বলা যায় না–সময় এখন সত্যি ভারী মন্দ।
মা বললেন-“থাকা না থাকা–পিকলুর দায় মস্ত,”
ইতিমধ্যেই কুকুরের নাম পিকলুই সাব্যস্ত।
অফিস থেকে ফেরেন বাবা–যেই না ঢোকেন ঘরে,
পিকলু অমনি লেজটা নেড়ে তাঁকে আদর করে।
“আরে আরে এটা কে রে”-তুলে নিলেন খাটে,
কুকুর বাবার এত প্রিয়–জানা ছিল না মোটে !
“কে দিল এমন কুকুর-‘গোল্ডেন রিট্রিভার’!
আমার পোষার শখ ছিল”-খুব উল্লাস তাঁর।
মায়ের কাছে সব শুনে বাবাও দারুণ খুশী,
আনন্দেতে দিদি কাঁদে,মা ত’ কাঁদে বেশী।
পিকলু রইল দিদির সাথে মোদের পরিবারে,
আমি,দিদি জলখাবার খাওয়াই দিলেম ছেড়ে।
মন দিয়ে পড়াশুনা–প্রথম হতেই হবে,
প্রথম হলেই পড়ার খরচ অনেক বেঁচে যাবে ।
পিকুর জন্য মাংস চাই হোক না যেমন করে,
ছোট্ট প্রাণী খুশীর হাওয়া আনল মোদের ঘরে।
সুখের অনেক আলো বুঝি ঘরে উপচে পড়ে,
মোকদ্দমায় বাবার জিত–ভাগ্য গেল ঘুরে।
“সাত বছরের মামলাতে পরাজয় নিশ্চিত,
সেই মামলায় আমার কিনা হলোই শেষে জিত !
সব কিছুই পিকুর হেতু–কুকুরটা পয়মন্ত,
অর্থ আর এ সংসারে হবেই না বাড়ন্ত।
ওর জন্য মাংস চাই–দিনে এবং রাতে, “
বাবার খুশী উপচে পড়ে হারা মামলা জিতে।
বাবার কথায় আমাদেরও খুশী অন্তহীন,
বুঝি এবার সত্যি মোদের পাল্টাচ্ছে দিন।
এর পরেও আরেক কাণ্ড–উন্নতি তাঁর পাকা,
বিশ বছরের চাকরী বাবার–ঘোরে তারও চাকা।
“পিকলু বাবুর হাতেই মোদের সুখের চাবিকাঠি,
ওকে ছাড়া আমরা অচল”-বাবার কথাই খাঁটি।
ধাপে ধাপে বাড়ে মোদের সংগতি আর বিত্ত,
পিকুর আদর বর্ধমান সেই সাথেই নিত্য।
পিকলু ছিল সব কথায় বাবা মায়ের বাধ্য,
মন্দ কাজ করায় তাকে–কার এমন সাধ্য !
সেই পিকুর হলেম মোরা ভক্ত একনিষ্ঠ,
তার পরশে কেমন করে হয়ে গেলেম শিষ্ট ।
চুক্তি হল দুজনার–পরস্পরের প্রতি,
রাখব নজর অহর্নিশ–জীবন পাবে গতি।
এবার মোদের পরীক্ষা–কি হয় কে জানে,
দিদির হল প্রথম স্থান, আমি এলাম তিনে।
কষ্ট হল খুবই আমার–পেল কেমন কান্না,
ওমা দেখি পিকুর চোখেও যেন জলের বন্যা।
জেদ চাপলো–আরো আমায় করতে হবে ভালো,
পরের বছর হৃদয় জুড়ে অনেক তারার আলো।
এমন করেই দিনে দিনে বয়স গেল বেড়ে,
বাবা মায়ের পাকা চুল–পিকুও পিছু ধরে।
দিদির তখন স্নাতোকত্তর–ভাইটির প্রযুক্তি,
তবুও মাঝে চালু ছিল কবেকারের চুক্তি।
কিন্তু পিকু–তার পায়ে যে জোর গিয়েছে কমে,
একা একাই শুয়ে থাকে–কেমন গেছে দমে।
হঠাৎ সেদিন দ্বিতল থেকে নামার সময় হায়,
পড়লো নীচে সিঁড়ির থেকে–প্রাণটি বুঝি যায়।
সে যাত্রায় বেঁচে গেলেও পঙ্গু হল পিকু,
তার জন্য মোদের সবার মনটা আঁকুপাঁকু।
অহর্নিশ করলো সেবা আমার দিদি তাকে,
এমনতরো ভালবাসা–অবাক হতেম দেখে।
দিদি ছিল আমার কাছে মা দুর্গার রূপে,
যাঁকে আমরা পূজা করি নিত্য জপে তপে।
মোদের বাড়ীর গর্ব দুটি–পিকলু এবং দিদি,
দিদি যেন অমরাবতীর অলকানন্দা নদী।
যে নদীতে যাবেই শেষে মোদের পিকলু ভেসে,
দুজনার কষ্টে আমার দুচোখ জলে ভাসে।
“একটা সুঁই দিলে পরে পাঁচ মিনিটের শেষে,
পিকলু সোনা যাবে চলে চিরশান্তির দেশে।”
ডাক্তারের নিদয় কথায় দিদির হাহাকার,
“এমন কাজ কখ্খনো নয়– শুনুন ডাক্তার।
মানুষ হলে এমনটা কি যায় কখনো করা !
এ বিষয়ে করতে নারি কোনই বোঝাপড়া।”
“পিকলু মোদের পরিবারের হৃদয় তথা প্রাণ,
এককথায় হয়ত সে আমারই সন্তান।
তার সঙ্গে নিষ্ঠুরতা–সেটি কৃতঘ্নতা,
শেষযাত্রায় রাখবে পিকু আমার কোলে মাথা।
যে কদিন বাঁচবে বাঁচুক–করবো সেবা আমি,
পিকলু আমার এই জীবনে সবার চেয়ে দামী।”
চলে গেলেন চিকিৎসক–বুঝলো পিকু বুঝি,
সহসা সে দিদির দিকে তাকায় সোজাসুজি।
চোখের কোণে জলের ফোঁটা–করুণ যেন দৃষ্টি,
সেই রাত্রে আকাশ ভাঙা মুষলধারায় বৃষ্টি।
রাত তখন দশটা বাজে–খাওয়ায় দিদি তাকে,
দুএক ফোঁটা দুধও বুঝি যায় না পিকুর মুখে।
আদর করে চুমু খেয়ে রাখল কোলে মাথা,
এবার যেন পিকুর সাথে দিদির কত কথা।
চোখগুলো হায় বন্ধ তবু–হঠাৎ মাথা তুলে,
কি বা কাকে দেখতে সে চায় নয়নদুটি খুলে।
অবশেষে দিদির দিকে পিকলু তাকায় ফের,
বললে যেন করুণ গলায় – “করলে সেবা ঢের।
এবার আমায় দাও মা বিদায়–পেওনা তুমি ব্যাথা,”
দিদির কোলেই পিকলু সোনার পড়লো নিথর মাথা।
চলে গেল পিকলু সোনা সেই বৃষ্টির রাতে,
নীরব মিছিল এগোয় মোদের পিকুর শব হাতে।
কাঁদছে দিদি, কাঁদছে মা–বলেন বাবা মোরে,
“ভাসিয়ে দাও পিকুর শব মা গঙ্গার নীরে।”
এক মায়ের কোল থেকে আরেক মায়ের কোলে,
বিসর্জন দিলেম তারে ভরা গঙ্গার জলে।
আজো একটা ধূপ জ্বলে সেই অমল ছবির পাশে
যেথায় পিকুর গলা জড়িয়ে আমার দুগ্গাদিদি হাসে।
বাবাও নেই, মাও নেই , দিদিও গেছে চলে,
কেবল আমি আজও ভাসি নীরব চোখের জলে।
——————————————————————-
মূল কাহিনী শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক সন্জীব চট্টোপাধ্যায়ের। তাঁর “ দিদি আর পিকলু”, – একটি মায়াময় ছোট কিশোর কাহিনীরকাব্যরূপ দেবার আমার একটি ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা মাত্র। মহান লেখকের প্রতি আমার অসীম কৃতজ্ঞতা।