একটা বিষন্ন বিকেলের গল্প

প্রিয়জনের সঙ্গে শেয়ার করুন :--👍

Loading

সেদিন বিকেল গড়িয়ে সন্ধা অবধি কেঁদেছি।
মাগো শেষ যাত্রায় তোমার সাথে দেখা হলোনা,
আর কোন কথাও হলো না।
শুধু দাফনের আগে আমার চোখে দেখা পৃথিবীতে
সবচেয়ে সুন্দর মুখখানা শেষবার দেখেছি।
আর তখনই কষ্টের জগদ্দল পাথরটা বুকে চেপে বসলো।
সবচেয়ে অসহায় “এতিম” শব্দটা এঁকে দিল হৃদয়ে।
মাগো! অনেক দিন……..বহু বছর ধরে
বুকে জমিয়েছিলাম কিছু কথা
তোমাকে বলবো বলবো করে আর বলাই হলো না।
কবর গালিচায় যেখানে তোমাকে শোয়ানো হলো
তার পাশেই বাবা আর বাবার কোল ঘেষে
ছোট ভাই রুবেল চির নিদ্রায় শায়িত।
অনেকটা পারিবারিক আবহ।
সারি সারি কবর, সুনসান নিরবতা।
মনে হলো এটা মৃতদের আবাসন।
এখানে সন্ধ্যে নামার সাথে সাথে
ঝিঁ ঝিঁ পোকারা সাইরেন বাজিয়ে
রাতের আঁধারকে স্বাগত জানায়।
আর মিট মিট করে জ্বলতে থাকা জোনাকিরা
সে আঁধারে ছড়ায় উল্কাবৃষ্টি ।
রাত একটু গভীর হতেই ফসফরাসের আলো
শুভ্রতার চাদরে ঢেকে দেয় বিরান মাঠ আর
সেই বিরান মাঠের এক কোনায় মিললো তোমার ঠাঁই।
মাগো খুব জানতে ইচ্ছে হতো;
অত কষ্ট করে কেন আমাকে জন্ম দিলে?
তোমার ছোট্ট পেটে যেদিন প্রথম আমার অস্তিত্ব টের পেলে
সেদিন কি তুমি খুশী হয়েছিলে নাকি অখুশী?
আমি জানতাম না। শুধু জানি তোমার নরম পেটে
অসংখ্যবার লাথি মেরেছি।
তোমার খাবারের নির্যাস চুরি করে
আমার পুষ্টিসাধন করেছি।
তোমার শ্বাস থেকে অক্সিজেন চুরি করে
আমি দম ফেলেছি।
ভূমিষ্ট হয়েই আমার তীব্র চীৎকারে
সব ব্যথা ভুলে গেলে তুমি এক ফুৎকারে।
তোমার শরীরের উষ্ণতা চুরি করে আমার হতো উম…..।
পৃথিবী ঘুমিয়ে গেলেও মাগো তুমি থাকতে নির্ঘুম।
তোমার আঁচলেই আমার শৌচকর্ম,
অথচ আমার পরিচর্যায় তোমার গলধঃঘর্ম।
তোমার বুকের রক্ত পিয়ে আমার যাপিত জীবন;
মাতৃত্বের গন্ধ মাতাল তোমার মরণ পণ।
কিশের নেশায় মাগো তোমার অমন মহান ত্যাগ;
জানবো বলে জমিয়েছি কথা কয়েক হাজার ব্যাগ।
সেসব কথা অজানাই থেকে গেল হায়!
জীবনের দায় কেন এভাবে ফুরায় হতাশায়।
মাগো!
কৈশোরে একদিন তোমার কাছে দু’আনা চাইলাম;
একটা টমটমি গাড়ী কিনবো বলে।
আবুর টমটমি গাড়ীর পেছনে হেটে হেটে
কত যে কষ্টের বিনোদন খুঁজেছি? আমাকে
গাড়ীটা একবার ছুঁতেও দেয়নি আবু।
তুমি পয়সা দিবানা বললেই হতো।
তা না করে তুমি লোভ দেখালে।
খুব মিষ্টি করে বললে, “আজ না বাবা”।
ক’দিন পরেই গেদিপাড়ার বটতলিতে
চৈত্র সংক্রান্তির মেলা বসবে।
দূর দূরান্ত থেকে কত মানুষ আসবে!
রওশন সার্কাস, নাগরদোলা, লাঠি খেলা আর
চুপ কথা এক আনা’র আসর বসবে।
বাতাসা, কদমা, খাগড়াই আরো…….
কত্তো রকমের মিষ্টান্ন মেলায় উঠবে।
মেলায় হরেক রকমের সুন্দর সুন্দর খেলনা পাওয়া যাবে……
টমটমী গাড়ী, কাগজের ঘূর্ণি ফুল,
মাটির পুতুল, তালপাতার পাখা, বাঁশের বাঁশি,
তারাচ্যাঙ আর রঙ বেরঙয়ের কত কিসিমের বেলুন।
তোর ভাইয়া সহ মেলায় যাবি।
সেদিন তোকে চার আনা দেবো।
চার আনা!
ঠিক আছে মা, আমি বটতলির মেলাতেই যাবো।
মাগো আমার সে মেলায় যাওয়া হয়নি;
আর সেই চার আনাও আমি পাইনি।
বাবার স্মৃতি বলাই বাহূল্য।
বাবার কথা মনে হলেই
চোখের সামনে ভেসে উঠে
জীবন যুদ্ধে রণক্লান্ত এক সৈনিক।
যার সারাক্ষন নিমগ্ন চায়ের কাপে বিষন্ন চুমুক।
অথবা……..
স্টার সিগারেটের কড়া ধুঁয়া ছুড়ে
আকাশ পানে অপলক চেয়ে থাকা
উদাসীন পথিক। আর শেষ রাতে
হাপরের শব্দের মত টেনেটেনে
শ্বাস নেয়া এক অকাল বৃদ্ধ ।
বাবা গত হয়েছেন অনেক আগেই।
তাকেও অনেক কিছু বলার ছিল,
কিছুই বলা হয়নি।
মাগো!
গোরস্থানের মতই তোমার ঘরটাও
আজ বিরান পড়ে আছে, কেউ আসে না।
মাঝে মধ্যে আজিরন এসে ঘরের সামনে
কিছুক্ষন বসে থেকে ফিরে যায়
কান্না ভেজা চোখে।
মাগো আমার না বলা কথাগুলো
অব্যক্তই থেকে গেল। আর
সেদিনের সেই বিষন্ন বিকেলটাই
শুধু ভাস্বর হয়ে রইলো।

0

Publication author

offline 2 years

Md. Moktarul Alam

0
NGO Worker
Comments: 0Publics: 43Registration: 20-10-2020
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

পরিচিতি বাড়াতে একে অপরের লেখায় মন্তব্য করুন। আলাপের মাধ্যমে কবিরা সরাসরি নিজেদের মধ্যে কথা বলুন। জমিয়ে তুলুন কবিতার আড্ডা।